বৃহস্পতিবার, ২রা মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ১৯শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

দুর্নীতির নেপথ্যে

সরকারের যতোগুলো ক্যাডার সার্ভিস রয়েছে তার মধ্যে স্বাস্থ্য এবং শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তাগণ চান তাদের সেক্টরগুলো সম্পূর্ণ দুর্নীতিমুক্ত হোক।

কিন্তু, অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে দেখলে দেখবেন, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা ক্যাডারে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি। তবে এই দুই সেক্টরের দুর্নীতির মধ্যে একটি মিল রয়েছে, সেটি হলো এই সেক্টর দুটিতে যারা প্রধান ধারক-বাহক তারা এই দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত নন। অমিল হলো স্বাস্থ্যখাতের দুর্নীতি অদৃশ্যমান আর শিক্ষা ক্ষেত্রে দুর্নীতি দৃশ্যমান।

যেমন, প্রশ্নপত্র ফাঁস শিক্ষা ক্ষেত্রে দৃশ্যমান দুর্নীতির একটি জাজ্বল্যমান উদাহরণ। কিন্তু, কোনো শিক্ষক এই দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত নন। আর স্বাস্থ্য সেক্টরে দুর্নীতি হয় যন্ত্রপাতি ক্রয়ে ও নির্মাণ কাজে। অর্থাৎ, দুর্নীতিগুলো হর্তাকর্তাদের টেবিলে-টেবিলে, ফাইলে-ফাইলে হয়। সেগুলো জনগণের চোখে ধরা পড়ে না।

তবে হ্যাঁ, ধরা পড়ে তখন, যখন একটি সিটি স্ক্যান বা এমআরআই করার জন্য সরকারি মেডিকেল কলেজে গিয়ে যন্ত্র নষ্ট হওয়ার কারণে সিটি এমআরআই না করেই বাসায় ফিরে যেতে হয় অথবা একটি আইভিইউ পরীক্ষার মেশিন সারাবছর নষ্ট হয়ে পড়ে থাকে। তখন জনগণ দোষ দেন ডাক্তারদের। তারা মনে করেন এই যন্ত্রপাতি বা হাসপাতালের সবকিছুর সঙ্গে ডাক্তাররা জড়িত।

আমি নিজে ডাক্তার না হলে হয়তো তাই মনে করতাম। কিন্তু, যে ঠিকাদার যন্ত্রটি কিনেছেন, বা প্রশাসনের সচিব যারা এই যন্ত্র ক্রয়ের ব্যাপারে জড়িত তাদেরকে আমরা কেউ কি দোষারোপ করেছি? আমরা কখনো তা করি না। এটিই হলো অদৃশ্যমান দুর্নীতি বা মাস্কড করাপশন। মাস্কড করাপশন মানে খালি চোখে যা দেখা যায় না, পর্দার আড়ালে ঢেকে থাকে, পর্দা সরালে দৃশ্যমান হয়।

মন্ত্রণালয়ে একটি মেডিকেল ইকুইপমেন্ট কেনার সময় জাপানি বা জার্মানির যন্ত্রপাতি কেনার জন্য টাকা বরাদ্দ করা হয়। আর কেনার সময় কেনা হয় চাইনিজ যন্ত্রপাতি। চাইনিজ জিনিসের আবার প্রকারভেদ রয়েছে। যেটি সবচেয়ে নিম্নমানের সেটি কেনা হয়। যন্ত্রটি দেশে আসতে আসতে সেটি বিকল হয়ে যায়। আর মেডিকেল কলেজে সেই যন্ত্র সেটআপ করতে করতে এর ওয়ারেন্টি শেষ হয়ে যায়।

একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানের কার্ডিওলজি বিভাগের একটি গল্প বললে আপনাদের কাছে বিষয়টি আরও পরিষ্কার হবে বলে আশা করি।

কার্ডিওলজি বিভাগে বেশি সংখ্যক রোগী যাতে সহজে কালার ডপলার ইকোকার্ডিওগ্রাম করতে পারেন এবং সঠিকভাবে রোগ নির্ণয়ের মাধ্যমে যাতে সঠিক চিকিৎসা সেবা পেতে পারেন সেই লক্ষ্যে তিনটি থ্রি-ডায়মেনশনাল কালার ইকোকার্ডিওগ্রাম মেশিন কেনা হয়েছে অনেক উচ্চমূল্য দিয়ে। মেশিনের ওয়ারেন্টি থাকে দুই বছরের। মানে দুই বছরের মধ্যে সেই যন্ত্রের কোনো সমস্যা হলে ঐ কোম্পানি যন্ত্রাংশ বদলে দিবে বা যাবতীয় দায়ভার বহন করবে।

কিন্তু, ইঞ্জিনিয়ারিং সেকশন, মন্ত্রণালয়ের কাজ ও প্রশাসনের দীর্ঘসূত্রিতার জন্য সেই যন্ত্র কার্ডিওলজি বিভাগে সেটআপ করতে সময় লেগে গেছে দুই বছর দুই মাস। সেটআপ করার পর দেখা যায়, তিনটি মেশিনের দুটিই নষ্ট। ওয়ারেন্টির সময়ও পার হয়ে গেছে। কোম্পানি কোনোভাবেই ওয়ারেন্টি উত্তীর্ণ জিনিসের মেরামত বিনামূল্যে করে দিবে না। আর যে দুটি মেশিনের পার্টস নষ্ট সেটি মেরামত করতে লেগে যাবে প্রায় এক কোটি টাকা। যে মেশিন আসতে দুবছর সময় লাগে, সেই মেশিন নষ্ট হওয়ার পর তার মেরামতের জন্য টাকা বরাদ্দ হতে কতোদিন লাগতে পারে বলে আপনাদের ধারণা? তিন বছরও যদি লাগে তাহলে মোট পাঁচ বছর যন্ত্রটি বিকল হয়ে পড়ে থাকবে।

কিন্তু, পাঁচ বছর পর টাকা হাতে পেলে, তখন যন্ত্রটি মেরামত অযোগ্য (ইরিভারসিবল ড্যামেজ) হয়ে গেলে সেই টাকা দিয়ে কী হবে? অর্থাৎ, যন্ত্র কেনার টাকা এবং যন্ত্র মেরামত করার পুরো টাকাই জলে গেলো। যে মেশিন দিয়ে জনগণের কোনো লাভ হলো না, কিন্তু সরকারের শুধু টাকাই খরচ হলো রাষ্ট্রের সেই টাকা ক্ষতির দায় কে নিবেন? এই হলো আমলাতন্ত্র বা প্রশাসনতন্ত্রের জটিলতা ও দীর্ঘসূত্রিতা।

সভ্য, শিক্ষিত আর বিবেকবান সমাজে সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করতে হয় না, সত্য এমনিতেই প্রতিষ্ঠিত হয়, আর মিথ্যাকে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইলে গল্প বানাতে হয়, যুক্তি দিতে হয়, তর্ক করতে হয়। আমাদের সমাজে উল্টোটিই ঘটছে। এখানে সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করতেই গল্প বানাতে হয়, যুক্তি দিতে হয়। এটি আমাদের সামাজিক ব্যবস্থার একটি ভুল ধারাবাহিকতা।

মানুষ যদি না জানেন যে এটি অন্যায়, এই অন্যায়টি কীভাবে সংগঠিত হচ্ছে- তাহলে তারা কিভাবে অন্যায়ের বিরুদ্ধে অবস্থান নিবেন?

যখন দেশের সব মানুষ জানেন এটি অন্যায়, এবং এটি কীভাবে হচ্ছে, তখন তারা এটির বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে পারবেন। দেশের বেশিরভাগ মানুষ যখন অন্যায়ের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন, তখন গণজাগরণ তৈরি হয়, বাংলাদেশেও দুর্নীতির বিরুদ্ধে গণজাগরণ তৈরি হওয়া শুরু হয়েছে। যারা দুর্নীতিবাজ তারা তাদের নিজেদের দুর্নীতি ধামাচাপা দেওয়ার জন্য প্রধান টার্গেট হিসেবে বেছে নিয়েছে সবচেয়ে নির্জীব ও সৎ দুটি পেশা। সব পেশাই ভালো কিন্তু চিকিৎসা এবং শিক্ষা দুটি মহান পেশা যেখানে একটি দেশের নাগরিকদের সুস্থভাবে বেঁচে থাকার এবং বিশ্বে শিক্ষিত ও সভ্য জাতি হিসেবে গড়ে উঠার নিশ্চয়তা প্রদান করে।

কিন্তু, চিকিৎসা এবং শিক্ষার মতো দুটি মহান পেশাকে কলঙ্কিত করার অপচেষ্টা করে যাচ্ছে একটি স্বার্থান্বেষী মহল।

একটি দেশে যখন শিক্ষা এবং চিকিৎসা পেশাকে সংকুচিত করার চেষ্টা করা হয় তখন দেশের মানুষের দুটি মৌলিক অধিকারের জায়গা সংকুচিত হয়।

যারা এই পেশা দুটিকে কলঙ্কিত করার চেষ্টা করে চিকিৎসা ও শিক্ষা সেক্টরকে সংকুচিত করার চেষ্টা চালাচ্ছেন তারা প্রকারান্তরে দেশের মানুষের অধিকারের জায়গাটিকে আবারও প্রশ্নবিদ্ধ করার নীতিহীন অপচেষ্টা করে যাচ্ছেন।

সেই অন্যায় আর দুর্নীতিকে রুখে দিতে সদা জাগ্রত জাতির প্রতীক্ষায় থাকলাম।

 

লেখক ডা. কাওসার আলম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্ডিওলজি বিভাগের মেডিকেল অফিসার ও রেসিডেন্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category